রেনেসাঁস বলতে কী বোঝো ? রেনেসাঁস শব্দের অর্থ কি? রেনেসাঁস কেন ইতালিতে শুরু হয়? রেনেসাঁস স্থাপত্যের মূল বৈশিষ্ট্য গুলি কি ছিল?
রেনেসাঁস ও রেনেসাঁসের বৈশিষ্ট্য
রেনেসাঁস বলতে কী বোঝো ?
উঃ রেনেসাঁস বলতে বুঝায় মানবমুক্তি, যুক্তিবাদ, ব্যক্তি স্বাধীনতা, জাগতিকতা ও মানবতাবোধ। এই পাঁচটিই ছিল রেনেসাঁসের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
রেনেসাঁস শব্দের অর্থ কি?
উঃ রেনেসাঁস শব্দের অর্থ নবজাগরণ।
রেনেসাঁস বা নবজাগরণ কেন ইতালিতে শুরু হয়?
উঃ কনস্ট্যান্টিনোপলে তুরকি আক্রমণের আশঙ্কা দেখা দিলে সেখানকার জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা তাঁদের প্রাচীন পুঁথিপত্র, গ্রিক ও রোমান সাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে ইতালিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এঁরা ইতালির বিভিন্ন বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন। এঁদের উদ্যোগে ইতালিতে আবার নতুন করে গ্রিক ও ল্যাটিন প্রাচীন সাহিত্য, শিল্প প্রভৃতির চর্চা শুরু হয়। এইসব চর্চা থেকেই রেনেসাঁস বা নবজাগরণের সৃষ্টি।
রেনেসাঁস স্থাপত্যের মূল বৈশিষ্ট্য গুলি কি ছিল?
উঃ রেনেসাঁসের প্রভাবে পশ্চিম ইউরোপে বিশেষত ইতালিতে গ্রিক ও রোমান সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস চর্চার জাগরণ বা জাগৃতি হয়। এর ফলে ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন চর্চা দেখা দিতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্তন ও শহরের বিকাশ মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করেছিল। প্রাচীন সাহিত্য ও দর্শনের প্রতি আগ্রহ ছিল রেনেসাঁসের প্রথম সূচনা। কিন্তু কেবলমাত্র পুরোনো দর্শন ও সাহিত্য পাঠের দ্বারাই রেনেসাঁস অবসিত হয়নি। রেনেসাঁস নতুন সৃষ্টির প্রেরণা দেয়। পুরোনো সাহিত্য, দর্শন পাঠের ফলে লোকের মনে চিন্তার স্বাধীনতা দেখা দেয়। নতুন কিছু জানবার, পুরোনোকে যুক্তির দ্বারা যাচাই করার মনোভাব জাগে। এর ফলে আধুনিক যুগের সূচনা হয়।
রেনেসাঁসের বৈশিষ্ট্য গুলি হল
(1) ধর্মীয় সাহিত্য ছিল মধ্যযুগের একমাত্র পাঠ্য। রেনেসাঁসের প্রভাবে সাধারণ সাহিত্য অর্থাৎ লোকের জীবন, ভালোবাসা, মৃত্যু, দুঃখপ্রভৃতিকে নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি হয়। এই সাহিত্যগুলি লোকের মুখের ভাষায় রচিত হয়। ল্যাটিন ছেড়ে কথ্য ভাষায় সাহিত্য রচনা ছিল একটা বড়ো পদক্ষেপ। এই সাহিত্য পড়তে লোকে বেশি আগ্রহী হয়।
(2) ইতিহাসকে গল্প হিসেবে না দেখে সমাজ হিসেবে চর্চা করা হয়। গবেষণার দ্বারা সঠিক তথ্য বের করে যুক্তির দ্বারা তার বিশ্লেষণ করার প্রথা ইতিহাস রচনায় দেখা যায়।
(3) শিল্পের ক্ষেত্রে মধ্যযুগীয় পথিক স্থাপত্যের স্থলে গ্রিক স্থাপত্যকে গ্রহণ করা হয়। ভাস্কর্যে গ্রিক ভাস্কর্যকে অবলম্বন করে নরনারীর মূর্তিগুলিকে খোদাই করা হয়।
(4) বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গ্রিক বিজ্ঞানের পিথাগোরাসের জ্যোতির্বিদ্যাকে গ্রহণ করা হয়। রেনেসাঁসের যুগে বিজ্ঞানী কোপারনিকাস 1543 খ্রিস্টাব্দে পিথাগোরাসের তত্ত্বকে হাতে কলমে পরীক্ষা করে বলেন যে, সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহগুলি ঘোরে। পরে গ্যালিলিও (1592 খ্রিঃ) প্রমাণ করেন পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে।
(5) রেনেসাঁসের যুগে ইউরোপের অভিযাত্রীরা ভৌগোলিক আবিষ্কারে প্রবৃত্ত হয়। মধ্যযুগের ধর্মীয় বাধা ও সামন্ততান্ত্রিক বিধিনিষেধ লোপ পেলে লোকে নতুনকে জানবার জন্য, বাণিজ্যের জন্য, ধর্ম প্রচারের জন্য নতুন দেশ আবিষ্কারের
কাজে লাগে।
(6) রেনেসাঁসের প্রভাবে মধ্যযুগীয় পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের পরিবর্তে জাতীয় রাষ্ট্র গড়ে ওঠে।
সাহিত্য, শিল্প ও বিজ্ঞানে রেনেসাঁসের প্রভাব আলোচনা করো।
উত্তরঃ সাহিত্য সৃষ্টিতে রেনেসাঁসের প্রভাব : রেনেসাঁসের প্রভাবে ইতালীয় ভাষায় অসাধারণ সাহিত্য রচনা করে নবজাগরণের দ্বারা উন্মোচন করেছিলেন দান্তে, পেত্রার্ক ও বোকাচ্চিও। এঁরাই ইতালীয় ভাষাকে একটি জাতীয় ভাষার মর্যাদা দিয়েছিলেন। রেনেসাঁসের ফলে আমরা ইংলন্ডে পাই শেক্সপীয়ারের যুগের মহান সাহিত্য আর কিছু ফ্রান্সের সাহিত্য সম্পদ।
শিল্প ও বিজ্ঞানে রেনেসাঁসের প্রভাব : রেনেসাঁসের শিল্পীরা নানা দেশে যে কীর্তি রেখে গেছেন সেগুলি আজও সমাদর পাচ্ছে। রাফেল, মাইকেল এঞ্জেলো ও লিওনার্দো-দ্য-ভিঞ্চি তাঁদের শিল্পকর্মে মানুষকে বড়ো করে তোলেন। শিল্প ও সাহিত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কারও এই সময় ঘটেছিল। তার ফলে অনেক প্রচলিত বিশ্বাস ভেঙে গিয়েছিল। যেমন, কোপারনিকাস আবিষ্কার করলেন পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। গ্যালিলিও দূরবিন আবিষ্কার করে প্রমাণ করলেন সৌরমণ্ডলের সব গ্রহই চলমান। ব্রুনো বললেন, সূর্য ও গ্রহগুলো সমস্তই নক্ষত্র জগতের অংশমাত্র। এইসব বিজ্ঞানী প্রচলিত বিশ্বাসের ওপর আস্থা না রেখে প্রকৃতিকে যাচাই করে নতুন জ্ঞানকে তুলে ধরেছিলেন।
রেনেসাঁস ইউরোপে জ্ঞানোন্মেষে কীভাবে সহায়তা করেছিল?
উত্তরঃ রেনেসাঁস ইউরোপে জ্ঞানোন্মেষে সহায়তা করেছিল। এর দুটি কারণ ছিল।
প্রথমত, নতুন সংস্কৃতি ইতালির নগররাষ্ট্রগুলির বণিকদের অর্থে পুষ্ট হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত,তখন আরব দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের ফলে ইতালিতে জ্ঞানচর্চা বৃদ্ধি পেয়েছিল। অন্যান্য দেশের সঙ্গেও ইতালির সাংস্কৃতিক যোগ স্থাপিত হয়েছিল। প্যারিস, অক্সফোর্ড,কেমব্রিজ, কলোন প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংখ্য পণ্ডিত তখন ইতালিতে পড়াশুনা করতে গিয়েছিলেন। ফলে জনগণের মধ্যে জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসার ঘটেছিল।