ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভারতের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার বর্ণনা দাও
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভারতের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার বর্ণনা দাও।
উঃ ১৭৬৫ খ্রি. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার ও ওড়িশার দেওয়ানি লাভ করে। কিন্তু ভারতের ভূমি-রাজস্ব সম্পর্কে ইংরেজ কর্মচারীদের কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকায় লর্ড ক্লাইভ প্রচলিত রাজস্ব ব্যবস্থা বহাল রেখে রেজা খাঁ ও সিতাব রায় নামে দুজন নায়েব- দেওয়ানের হাতে রাজস্ব আদায়ের ভার দেন। কিন্তু পরিণামে বাংলায় ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর' দেখা দেয়। এ কারণে ইংরেজ কোম্পানি রাজস্ব নীতি পরিবর্তনের চিন্তাধারা শুরু করে।
হেস্টিংসের রাজস্বনীতি
ওয়ারেন হেস্টিংস (১৭৭৩-৮৫) প্রথমেই দুজন অত্যাচারী রাজস্ব আদায়কারী রেজা খাঁ ও সিতাব রায়কে বরখাস্ত করেন। তিনি সর্বপ্রথম ভারতে ভূমি-রাজস্ব সম্পর্কে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। রাজস্ব ব্যবস্থা তত্ত্বাবধানের জন্য Board of Revenue বা রাজস্ব বোর্ড গঠন করেন। রাজস্ব আদায়ের জন্য নতুন কর্মচারী হিসাবে ‘কালেক্টর’ নিয়োগ করেন। রাজস্বের পরিমাণ স্থির করার জন্য এবং সর্বাধিক রাজস্ব সংগ্রহের জন্য হেস্টিংস জমিদারদের সঙ্গে নিলামের ভিত্তিতে ‘পাঁচসালা বন্দোবস্ত’ বা পাঁচ বছরের জমি বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। কিন্তু এই ব্যবস্থায় কোম্পানির আয় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে এবং কৃষকদের দুর্দশা আরও বৃদ্ধি পায়। তাই ১৭৭৭ খ্রি. তিনি পাঁচসালা বন্দোবস্ত তুলে দিয়ে ‘একসালা বন্দোবস্ত’ প্রবর্তন করেন।
১৭৭৬ খ্রি. বাংলার ভূমি বন্দোবস্ত ও ভূমি-রাজস্ব সম্পর্কে অনুসন্ধানের জন্য ‘আমিনি কমিশন' গঠন করেন। এই কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে উৎপন্ন ফসলের এক পঞ্চমাংশ খাজনা ধার্য হয়। এরই ভিত্তিতে ‘একসালা বন্দোবস্ত’ প্রবর্তন হয়। ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৭৮১ খ্রি. 'কমিটি অফ রেভেনিউ' গঠন করেন এবং কালেক্টর পদ তুলে দেন।
কর্নওয়ালিশের ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা
হেস্টিংসের পর লর্ড কর্নওয়ালিশ ভারতে আসেন এবং নতুন ভূমি বন্দোবস্ত করেন। তিনি ইংল্যান্ডের প্রচলিত জমিদারি প্রথার মতো ভারতেও একশ্রেণির অনুগত জমিদার শ্রেণি সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন এবং সেই সঙ্গে কোম্পানির আয় সুনিশ্চিত ও বিশৃঙ্খলা দূর করার জন্য হেস্টিংস প্রবর্তিত ভূমিব্যবস্থা তুলে দিয়ে জমিদারদের সঙ্গে দশ বছরে জন্য ‘দশসালা বন্দোবস্ত’ প্রবর্তন করেন।
পরবর্তীকালে ভূমি-রাজস্ব সংক্রান্ত সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য ১৭৯৩ খ্রি. ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ প্রবর্তন করেন। এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য জন শোর ও চার্লস গ্রান্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই ব্যবস্থা অনুসারে- (i) জমিদার শ্রেণি বাংলা, বিহার, ওড়িশায় বংশানুক্রমিকভাবে জমির মালিকানা ভোগ করার অধিকার পায়। (ii) জমিদাররা আয়ের ভাগ রাজস্ব কোম্পানিকে দিতে রাজি হয়। (iii) প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ও রাজস্ব অপরিবর্তিত থাকবে এবং (iv) ‘সূর্যাস্ত আইন’ অনুসারে সূর্যাস্তের পূর্বে রাজস্ব প্রদান না করলে সেই জমিদারি নিলাম করার কথা বলা হয়।
এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কোম্পানির আয় যেমন নিশ্চিত হয়, সে-রকম আয় বৃদ্ধি পায়, এবং কোম্পানির অনুগত জমিদার শ্রেণি সৃষ্টি হয় ঠিকই, কিন্তু কৃষকদের দুর্দশা চরমে ওঠে। ভুঁইফোঁড় মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়, জমিদারের নায়েব, গোমস্তা এবং নতুন জমিদার শ্রেণির শোষণ ও অত্যাচারে কৃষক সমাজের নাভিশ্বাস ওঠে।
রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত
১৮২০ খ্রি. বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে ‘রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত' প্রবর্তিত হয়। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে কোম্পানির আধিপত্য সুদৃঢ় হওয়ার পর রায়ত বা প্রকৃত চাষির কাছ থেকে সরাসরি রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা ‘রায়তওয়ারি ব্যবস্থা’ নামে পরিচিত। এই ব্যবস্থা অনুসারে কৃষক জমি স্বত্ব লাভ করে এবং নির্দিষ্ট রাজস্বের বিনিময়ে প্রতিটি কৃষকের সঙ্গে ত্রিশ বছর মেয়াদি জমি বন্দোবস্ত হয়।
মহলওয়ারি ব্যবস্থা
১৮২২ খ্রি. নিয়ম-বিধি জারি করে গাঙ্গেয় উপত্যকায়, বিশেষত উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লি এবং পাঞ্জাবে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিটি কৃষকের পরিবর্তে প্রতিটি গ্রামের গোষ্ঠীর সঙ্গে যে রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় তা ‘মহলওয়ারি বন্দোবস্ত’ নামে পরিচিত। প্রতি গ্রামের রাজস্বের পরিমাণ মোট হিসেবে নির্দিষ্ট হত এবং একজন ব্যক্তির মাধ্যমে আদায়ের ব্যবস্থা হয়। তা ছাড়া এই ব্যবস্থায় তিরিশ বছর অন্তর খাজনা ‘পুনর্বিবেচনার সুযোগ’ ছিল। এর ফলে ব্যক্তিগতভাবে কৃষকদের উপর করের বোঝা বেড়ে যায়।
ভাইয়াচারি বন্দোবস্ত
পাঞ্জাব অঞ্চলে মহলওয়ারি ব্যবস্থা ছাড়াও কোনো কোনো অঞ্চলে ‘ভাইয়াচারি রাজস্ব ব্যবস্থা’ প্রবর্তিত হয়। প্রতিটি গ্রামের কৃষক, জনপ্রতিনিধি ও কালেক্টরের সঙ্গে যৌথভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে খাজনা নির্ধারিত হত। এটি ‘ভাইয়াচারি বন্দোবস্ত’ নামে পরিচিত। এই ব্যবস্থায় কয়েক বছর ছাড়া ছাড়া রাজস্ব বৃদ্ধির নিয়ম ছিল।