মাদার টেরিজা রচনা
মাদার টেরিজা রচনা
“মা টেরিজা বিশ্বশান্তি,
মূর্তিমতি করুণা,
সেবা যাহার জীবন ব্রত,
প্রেম ধর্মের সাধনা।”
ভূমিকা
মানুষের ইতিহাসে মাঝে মাঝে এমন দুই একজন মহান পুরুষ বা মহীয়সী নারীর আবির্ভাব ঘটেছে যাঁদের অবস্থান সাধারণ মানুষের সহস্রগুণ ঊর্ধ্বে, যাঁরা মমতায় ও মহানুভবতায় বিশ্বজনের প্রাণের মানুষ হয়ে ওঠেন। এমন একজন মহীয়সীকে ভারতীয়রা তাদের আপনজন রূপে পেয়ে ধন্য হয়েছিল। এই মানবসেবিকা ছিলেন মহিমময়ী ‘মাদার টেরিজা'।
জন্ম, শৈশব ও শিক্ষাজীবন
১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে আগস্ট আলবেনিয়ার অভি সাধারণ এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন অ্যাগনেস। এই অ্যাগনেসই পরবর্তী কালে হয়েছেন মাদার টেরিজা। মা, বাবা আর তিন ভাই বোনের ছোটো সংসার। তিন ভাই বোনের মধ্যে দুই বোন আর এক ভাই ধর্মপ্রাণা মায়ের কাছেই তাঁর প্রথম শিক্ষা শুরু। ধর্মভীরু পরিবারের কন্যা হয়েও কোনো ক্যাথলিক স্কুলে না গিয়ে সরকারি স্কুলেই পড়াশুনা শুরু করেন। সেই স্কুলে কোনো ধর্মানুশীলনের ব্যবস্থা না থাকলেও নিকটবর্তী এক ধর্মযাজকদের প্রতিষ্ঠানের প্রভাব পড়ে তাঁর শিশুমনে। সেই বয়স থেকেই তিনি দুঃস্থ ও অসুস্থ মানুষের সেবায় আগ্রহী।
ভারতে আগমন ও কর্মজীবন
শিক্ষা ও সেবামূলক কাজ নিয়ে কলকাতায় আসার জন্য অ্যাগনেসের আগ্রহ লক্ষ্য করে ধর্মযাজকেরা আয়ার্ল্যান্ডের লোরেটোর ‘জান্’ বা সন্ন্যাসিনীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে আঠারো বছর বয়সে অ্যানগেস্ স্বদেশ ও স্বজন ছেড়ে আয়ার্ল্যান্ডের পথে পাড়ি দিলেন। পরের বছর ১৯২৯-এ এসে পৌঁছুলেন কলকাতায়। মা-বাবা ভাই বোনের মমতাময় সংসার পরিত্যাগ করে সেই যে চলে এসেছিলেন কলকাতায় তারপর আর কখনও সংসারমুখী হননি।
ঈশ্বরের আদেশ লাভ ও সেবাকার্য শুরু
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে একদিন দার্জিলিং যাওয়ার পথে ট্রেনে বসেই তিনি যেন ঈশ্বরের আদেশ পেলেন—লোরেটোর নিশ্চিন্ত জীবন পরিত্যাগ করে তাঁকে সহায় সম্বলহীন বস্তিবাসী দরিদ্রনারায়ণের সেবায় নামতে হবে।
কর্মকাণ্ড ও তার বিস্তার
অদম্য আগ্রহ আর অশেষ আত্মবিশ্বাস নিয়ে প্রথমে একাই কাজে নেমে পড়েছিলেন। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম সহকারিনী পেলেন। তারপর ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ৫ই অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হল ‘মিশনারিজ অব্ চ্যারিটি’; কলকাতার লোয়ার সার্কুলার রোডে ; সম্বল মাত্র পাঁচটা টাকা আর দশজন সহযোগিনী। মাদার এখন সাদা- মোটা নীল পাড় শাড়ি পরিহিতা সেবাব্রতা করুণাময়ী সন্ন্যাসিনী। কর্মচঞ্চলা মাদার-এর এই রূপই সর্বজন বিদিত। দিনে দিনে প্রসার লাভ করতে শুরু করলো তাঁর প্রতিষ্ঠান।
দেশবিদেশে সম্মান লাভ
এই মহামানবী জন্মসূত্রে বিদেশিনী হলেও এই কলকাতাকে ভালোবেসে তিনি ভারতীয় নাগরিক হয়েছিলেন। দেশ বিদেশের বিভিন্ন সংস্থা থেকে এই ভারতীয় তাঁর বিপুল কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতিস্বরূপ বিচিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে ভারতসরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ঐ বৎসরই ফিলিপিনস থেকে পেলেন ম্যাগাসাইসাই পুরস্কার। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে পেলেন ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার’। পর বৎসরই পেলেন ‘ভারত রত্ন’ উপাধি। সোভিয়েত ল্যান্ড নেহরু পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছিলেন মাদার। প্রায় সারা বিশ্বই তাঁকে নানা ভাবে সম্মানিত করেছে।
প্রয়াণ
১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দের ৫ই সেপ্টেম্বর ৮৭ বছর বয়সে মাদার টেরিজা খ্রিস্টলোকে প্রয়াণ করলেন। কায়ায় তিনি আজ আমাদের মাঝে না থাকলেও বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ের বেদিতে তিনি আজও অবস্থান করছেন। কবির ভাষায় বলা যায়—
“নয়ন সম্মুখে তুমি নাই
নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই।”
উপসংহার
মৃত্যু মানুষের জীবনে এক অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। কর্মের মধ্য দিয়েই মানুষ মৃতুঞ্জয়ী হয়। বিশ্বজননী মা টেরিজার বিপুল ব্যাপক মহান কর্মকাণ্ডের জন্য বিশ্ববাসী তাঁকে স্মরণ করবে এবং তাঁর আদেশে অনুপ্রাণিত হবে। তাঁর জন্য ভারতবাসী হিসেবে আমরা গর্বিত।