পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন শিল্প প্রবন্ধ রচনা

পশ্চিমবঙ্গে পর্যটন শিল্প রচনা

ভূমিকা

“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে।”
পথিক-প্রাণ মানুষের পথ চলার শেষ নেই। অন্তহীন তার এই যাত্রা। পথের নেশায় গৃহসুখ তার কাছে তুচ্ছ। “থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে”—এই আশা নিয়ে ছুটে যায় সিংহল থেকে হিমালয়ে। দেশ-দেশান্তরে তার ক্লান্তিহীন অবিরাম ছুটে চলার জন্য হাতছানি দিয়ে ডাকে সমুদ্র-পর্বত-অরণ্য। অজানা পৃথিবীর সেই দুর্নিবার আহ্বানে বারবার অভিযাত্রিকের দল উতলা হয়েছে, ঘড় ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে দুর্গমের অভিসারে, এ চলার শেষ নেই, তাই পর্যটন নেশা হয়ে দাঁড়ায়।

পর্যটনের গুরুত্ব

একসময় পর্যটন ছিল ধনীর বিলাস। কিন্তু বর্তমানে পর্যটন শুধু প্রমোদ ভ্রমণই নয় এর সঙ্গে রয়েছে দেশের অর্থনৈতিক জীবনের গভীর সম্পর্ক, অর্থনৈতিক পরিভাষায় দেশভ্রমণ এখন পর্যটন শিল্প। ভ্রমণ এখন বিদেশি মুদ্রা অর্জনের অন্যতম উপায়। সারা বিশ্বেই পর্যটনের আজ অপরিসীম গুরুত্ব। রাষ্ট্রসংঘ ১৯৭৬ সালকে ‘আন্তর্জাতিক পর্যটন বর্ষ’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। পর্যটনকে বলেছে ‘শান্তির ছাড়পত্র’। এই পর্যটনের মধ্য দিয়েই বিভিন্ন দেশের মানুষ পরস্পরের সান্নিধ্য লাভ করে এবং পরিচিত হয় ভিন্ন-ভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে। এতে রাজনৈতিক বোঝাপড়ার ক্ষেত্র হয় প্রশস্ত। ভাবের আদানপ্রদানে সৃষ্টি হয় বিশ্বশান্তির অনুকূল পরিবেশ। বিশ্ব মানবতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয় মানুষ।

পর্যটন শিল্প ও পশ্চিমবঙ্গ

পশ্চিমবঙ্গ প্রাকৃতিক সম্পদে ঐশ্বর্যমণ্ডিত। রয়েছে উন্নতশীর্ষ হিমালয়, রয়েছে সীমাহীন বারিধি, ভ্রমণ-বিলাসীরা আজও ছুটে আসে ইতিহাসের ভগ্নাবশেষ বহু স্মৃতি বিজড়িত মুর্শিদাবাদে, গৌড় কিংবা পাণ্ডুয়ায়, ঘুরে বেড়ায় অতীত বাণিজ্য-বন্দর তাম্রলিপ্তের নির্জনতায়, ছুটে যায় বেলপাহাড়ী-কাঁকড়াঝোরের আদিবাসী এলাকায়। যায় মুকুটমণিপুরের জলাধারে, শুশুনিয়া পাহাড়ে। যায় খেজুরী হিজলীর সমুদ্র সৈকতে, বেথুয়াডহরীর বন বাংলোয়, হাতছানি দেয় কত মন্দির, কত অনুপম স্থাপত্য, তরাই-সুন্দরবনের গভীর অরণ্য ভ্রমণ বিলাসীদের কাছে দুর্নিবার আকর্ষণ।

পশ্চিমবঙ্গের দর্শনীয় স্থান

এমনি আরও কত মনোমুগ্ধকর স্থান রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। উত্তরবঙ্গে দার্জিলিং-এর দিগন্ত জোড়া সবুজ গালিচার মতো চা বাগান, রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য শান্তিনিকেতন, দীঘার সমুদ্র সৈকত, বিষ্ণুপুর-বাঁকুড়ার বিখ্যাত মন্দির, বাঁকুড়া-কৃয়নগরের মৃৎশিল্প, আধুনিক ভারতের প্রাণকেন্দ্র তিলোত্তমা কলকাতাতে রয়েছে চিড়িয়াখানা, বিড়লা তারামণ্ডল, ভিক্টোরিয়া স্মৃতি সৌধ, মেট্রো রেল, সায়েন্স সিটি, যাদুঘর প্রভৃতি। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে শিল্পনগরী দুর্গাপুর, চৈতন্যদেবের জন্মভূমি নবদ্বীপ, রামকৃষ্ণদেবের সাধনপীঠ দক্ষিণেশ্বর, জয়দেবের কেন্দুবিল্ব, বাণিজ্য বন্দর হলদিয়া এমনি আরও কত খ্যাত-অখ্যাত গ্রাম-শহর ভ্রমণ বিলাসীদের পবিত্র স্পর্শে প্রাণময় হয়ে উঠতে পারে।

পর্যটন শিল্পে মেলার অবদান

আমাদের রাজ্যে তীর্থস্থানগুলিতে যে পাণ্ডারাজের মাতামাতি কায়েম হয়েছে তাতে সেগুলি আগামীদিনে সাধারণ মানুষের কাছে আকর্ষণীয়তা হারালেও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে যে সব মেলার আয়োজন করা হয়। পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মেলাগুলি আরও উজ্জীবিত হবে এবং তা পর্যটন শিল্পের প্রসারে সহায়তা করবে। পশ্চিমবঙ্গে উল্লেখযোগ্য মেলা বলতে কেন্দুলির জয়দেবের মেলা, শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা, গঙ্গাসাগর মেলা, তারকেশ্বরের শ্রাবণী মেলা, মাহেশের রথের মেলা, শান্তিপুরের রাসের মেলা ইত্যাদি। এছাড়া শারদ উৎসব উপলক্ষে কলকাতা এবং জগদ্ধাত্রী পুজো উপলক্ষে চন্দননগর ও কৃষ্ণনগর ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে বিশেষ মর্যাদা লাভ করে।

পর্যটন শিল্পে সরকারের উদ্যোগ

অর্থনৈতিক জীবনেও নতুন দ্বার উদ্ঘাটন করতে পারে পর্যটন শিল্প। পর্যটনের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের এক বিরাট ও বৈচিত্র্যময় সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এখানে পর্যটকদের সংকুচিত আগমন পর্যটন শিল্প প্রসারের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মূলত পর্যাপ্ত বাসস্থান ও পরিবহন ব্যবস্থার অভাবই এর কারণ। আশার কথা এই যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে সচেষ্ট হয়েছেন। জনমানবহীন দীঘার সন্নিকটে মন্দারমণি, জুনপুর, শঙ্করপুর প্রভৃতি অঞ্চলে হোটেল-রেস্তোরা গড়ে উঠছে। সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র কলকাতায় ক্রমশই পর্যটকদের সংখ্যা বাড়ছে। কলকাতাকে শ্রেষ্ঠ মনোমুগ্ধকর স্থান হিসাবে গড়ে তোলার জন্য কলকাতা কর্পোরেশন সি.এম.ডি.এ-এর প্রতিনিধিদের নিয়ে তৈরি করেছে ‘কলকাতা পর্যটন পর্ষদ'।

পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ

পশ্চিমবঙ্গে ভ্রমণ বিলাসীদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ও পশ্চিমবঙ্গকে আরোও আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলার জন্য নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এই শিল্পের দিন দিন সম্প্রসারণ ঘটছে, গড়ে উঠছে নতুন নতুন পর্যটন বাসভবন। দর্শনীয় স্থানের তাৎপর্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বোঝাবার জন্য নিযুক্ত হয়েছে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পর্যটন প্রদর্শক। পশ্চিমবঙ্গের প্রধান আকর্ষণ দার্জিলিং, কাঞ্চনজঙ্ঘা, এখানকার বিস্তৃত সবুজ চা-বাগান, উঁচু গাছের গভীর বন, পাহাড়ি নদী, টাইগার হিলে সূর্যোদয়, ঘুমে বৌদ্ধ বিহার যা বার বার মানুষকে ঘরছাড়া করেছে। কার্শিয়াং-এ পাঁচ হাজার ফুট উঁচুতে ‘ঈগাল ফ্ল্যাগ’-এ স্থাপন করা হয়েছে একটি পর্যবেক্ষণ প্যাভেলিয়ান, এতে পর্যটকরা কাঞ্চনজঙ্ঘা ও নেপালের পর্বতমালার সৌন্দর্য দেখবার সুযোগ পায়। এছাড়া জলদাপাড়া অভয়ারণ্যে তৈরি হয়েছে টুরিস্ট বাংলো। ১৯৭৯ সালে চালু হয়েছে মিরিক প্রকল্প। মিরিক লেকে ১৯৮১ সালে নৌকা বিহারের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন কর্পোরেশনের উদ্যোগে খোলা হয় শিলিগুড়ি টুরিস্ট লজ। ১৯৮২ সালে ঝাড়গ্রামে একটি পর্যটন আবাস খোলা হয়েছে। ওই বছরেই মেদিনীপুর জেলার কাঁকড়াঝোরে খোলা হয়েছে একটি টুরিস্ট ডর্মিটরি। পর্যটকদের থাকার সুবিধার জন্য রাজ্য সরকার কার্শিয়াং-এর লুইস-জুবিলি স্যানেটোরিয়ামটি নিয়ে নিয়েছেন, সুন্দরবনে কন্ডাক্টেড ট্যুরের ব্যবস্থা করা হয়েছে, সুন্দরবনের সজনেখালিতে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য পাঁচলক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।

উপসংহার

আজ ভারতের দিকে দিকে পর্যটন শিল্পের বিচিত্র সম্ভার। দলে দলে স্বদেশি- বিদেশি পর্যটকের দল ছড়িয়ে পড়ছে ভারতের সর্বত্র। স্মৃতি বিজড়িত অতীত-বর্তমানের শহরে-নগরে-বন্দরে-সমুদ্র সৈকতে অভিযাত্রীদের নিত্য আনা-গোনা, ভারতের সর্বত্র আজ এই পর্যটন শিল্পের যে মহাযজ্ঞের আয়োজন চলছে, পশ্চিমবঙ্গও সেই আয়োজনের অন্যতম শরিক। পশ্চিমবঙ্গও এক মহৎ ঐতিহ্যের ধারক। পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে বহু নিসর্গ সম্পদ, কুটির শিল্পের ঐতিহ্য, আর আছে অতীত ইতিহাস। পর্যটকদের চোখে ধরা পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের এক মহান পবিত্র চিত্র। পশ্চিমবঙ্গের এই সৌন্দর্যজগতে বিশ্বমানবের আমন্ত্রণলিপি সে রচনা করে কবির এই বাণীতে—
“তারি লাগি রাত্রি অন্ধকারে
চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগাত্তর পানে
ঝড় ঝঞ্ঝা বজ্রপাতে ।”
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url