তোমার প্রিয় লেখক প্রবন্ধ রচনা ( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
আমার প্রিয় লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমি তোমাদেরই লোক।”
কবিসমাজ ও রবীন্দ্রনাথ
একথা যিনি কাব্যে কবিতায়, গানে গানে প্রাণে প্রাণে সঞ্চার করেছিলেন, তিনিই বাংলা সাহিত্যে কবি সার্বভৌম, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়। ইংরেজি সাহিত্যে যেমন শেক্সপীয়ার, ফরাসি সাহিতে যেমন ভিক্টর হুগো, ইতালীয় সাহিত্যে যেমন দান্তে, জার্মান সাহিত্যে যেমন মহাকবি গ্যেটে, সংস্কৃত সাহিত্যে যেমন কালিদাস—তেমনি বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ কবির কবি মহাকবি। সিদ্ধিদাতা গণেশ, রূপকথার রাজপুত্র। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ভাবধারা এই মহাকবির মধ্যে মিলেমিশে এক মহাসাগর সৃষ্টি করেছে। তিনি বহুমুখী প্রতিভার আশীর্বাদ ধন্য, বিশ্ববরেণ্য কবি। তাই অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত বলেছেন—
“তুমি ছাড়া আর কার,
এ উদাত্ত হাহাকার,
হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা,
অন্য কোনখানে।”
জন্ম, শিক্ষা ও কর্মজীবন
রবীন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছিল ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ, শহর কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে। বাবা দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন ব্রাহ্ম। ঋষির মতো ছিলেন বলে, তিনি 'মহর্ষি' হিসাবেই পরিচিত ছিলেন সমধিক। বিদ্যালয়ের হৃদয়হীন নির্মম গতানুগতিকতা শিশু রবীন্দ্রনাথের পছন্দ ছিল না। তাই তাঁর বিদ্যালয়ের পড়াশোনা বেশিদূর এগোয়নি। তবে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাডেমি এবং সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে কিছুদিন তিনি পড়াশোনা করেছিলেন। সতেরো বছর বয়সে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য তাঁকে বিলেত পাঠানো হয়। দেড় বছর ইংল্যান্ডে থাকবার পর তাঁকে দেশে ফিরতে হয়। ব্যারিস্টারি পড়া তাঁর শেষ পর্যন্ত হয়নি। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাবার নির্দেশে তিনি জমিদারি দেখবার দায়িত্বভার পান। এই জমিদারি দেখার সূত্রে তিনি পদ্মালালিত বিরাট এক জনপদের সঙ্গে পরিচিত হন শিলাইদহসাজাদপুর -পতিসরের প্রকৃতি এবং এখানকার সাধারণ মানুষদের তিনি দেখার সুযোগ পান খুব কাছ থেকে। কবি জীবনে পদ্মালালিত এই জনপদের প্রভাব অনেকখানি।
কবিত্ব
রবীন্দ্রনাথের কবিত্ব শক্তির বিকাশ ঘটেছিল অতি শৈশবকাল থেকে। নয় বছর বয়স থেকেই তিনি সুন্দর সুন্দর কবিতা লিখতে পারতেন। 'বনফুল’, ‘কবি কাহিনী' এবং 'ভানুসিংহের পদাবলী’ তাঁর কৈশোর ও প্রথম যৌবনে লেখা কাব্যগ্রন্থ। তিনি যখন ইংল্যান্ডে ছিলেন, সেই সময় ‘ভারতী’ পত্রিকায় তাঁর লেখা ‘য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র' প্রকাশিত হয়। চলিত ভাষায় লেখার উজ্জ্বল উদাহরণ হিসাবে আজও এই চিঠিগুলি
সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নতুন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং বউঠান কাদম্বরী দেবী রবীন্দ্রনাথকে কবিতা রচনায় সর্বদা অনুপ্রাণিত করতেন।
সাহিত্যের নানা দিক
রবীন্দ্রনাথ কেবল কবিতাই লিখতেন না তিনি গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য ও সংগীত ইত্যাদি সব লেখাতেই তাঁর নিয়োজিত। তাঁর ছোটোগল্পগুলি আজও অসাধারণ। 'কাবুলিওয়ালা’, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘গুপ্তধন’, ‘পোস্টমাস্টার', ‘দেনা পাওনা’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ইত্যাদি গল্পগুলি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গল্প হিসাবে বিবেচিত হয়।‘নৌকাডুবি’, ‘চোখের বালি’, ‘গোরা', 'রাজর্ষি' ইত্যাদি উপন্যাসের তুলনা হয় না। 'বিসর্জন', ‘রাজা ও রানী’, ‘রক্তকরবী’, ‘ডাকঘর’, ‘অচলায়তন 'ইত্যাদি নাটকের সঙ্গে ‘শ্যামা’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘চণ্ডালিকা প্রভৃতি নৃত্যনাট্যের রচয়িতা হিসাবে রবীন্দ্রনাথ আজও আমাদের কাছে প্রিয়।
প্রতিভার স্বীকৃতি
তবে তাঁর প্রতিভার সবিশেষ বিকাশ ঘটেছে কবিতা ও সংগীতে। ‘মানসী’ ‘সোনার তরী’, ‘কল্পনা’, ‘গীতাঞ্জলি’, ‘গীতালি’, ‘গীতিমাল্য’, থেকে 'বলাকা', 'পূরবী', 'ক্ষণিকা’, ‘চৈতালি’, ‘শ্যামলী', 'পুনশ্চ', 'আরোগ্য’, ‘নবজাতক', ‘শেষ লেখা’ ইত্যাদি কাব্যের মধ্য দিয়ে তিনি যে কাব্য-জগৎ তৈরি করেছেন, তার তুলনা পৃথিবীর যে-কোনো সাহিত্যে দুর্লভ। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর এই কবি-প্রতিভা বিশ্বসভায় স্বীকৃতি পায় এবং তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবি হিসাবে ‘নোবেল’ পুরস্কার লাভ করেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিশ্বজুড়ে অঢেল সম্মানও পান। দেশে দেশে তাঁর কাব্যের ও সাহিত্যের অনুবাদ শুরু হয়ে যায়, যা আজও অব্যাহত। ইংরেজ সরকার তাঁকে 'নাইট' উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন।
ব্যক্তিত্বের নানাদিক ও শান্তিনিকেতন
কেবল কবি নন, ব্যক্তি হিসাবেও তিনি ছিলেন অসাধারণ। তিনি নিজে গান গাইতে পারতেন এবং ছিলেন খুব উঁচু-দরের চিত্রশিল্পী। তাঁর স্বদেশপ্রীতি ও স্বদেশানুরাগ এতই গভীর ছিল যে, তিনি জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তাঁর বহু খ্যাত 'নাইট' উপাধি ত্যাগ করেন। দেশবাসীকে যথার্থ পরিবেশে প্রকৃত শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি বোলপুরের কাছে প্রতিষ্ঠা করেন, ‘শান্তিনিকেতন’। ‘বিশ্বভারতী’ ছিল তাঁর আদর্শে তৈরি একটি অনুপম শিক্ষায়তন। তিনি একাধারে ছিলেন একজন বড়ো দার্শনিক, বড়ো চিত্রকর, বড়ো সংগীতজ্ঞ এবং বড়ো একজন অভিনেতাও। আবার তিনি ছিলেন একজন আচার্যও। সর্বযুগের সর্বকালের সেরা মানুষ হলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ আমাদের সকলের গর্ব।—
জগৎ কবির সভায় মোরা আজিকে করি গর্ব,
বাঙালি আজি গানের রাজা, বাঙালি নহে খর্ব ॥
আশি বছর বয়সে ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২শে শ্রাবণ তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
উপসংহার
রবীন্দ্রনাথ উচ্চকোটি প্রজ্ঞানী, আবার তিনিই মানুষের কবি, মানববেদনার পুরোহিত। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের এক বিস্ময়। তিনি সগর্বে বলেছেন—
“আমি পৃথিবীর কবি, যেথা তার যত উঠে ধ্বনি,
আমার বাঁশীর সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি।”
তাই, কবিগুরুর কাছে সমাজ ও সাহিত্য চিরঋণী, তিনি আমাদের চির-নমস্য।
এই তথ্য নিয়ে আরও যেসব রচনা লেখা যায়, সেগুলি হল-
1. তোমার প্রিয় কবি রচনা
2. তোমার প্রিয় লেখক রচনা
3. তোমার প্রিয় গ্রন্থকার রচনা
4. পঁচিশে বৈশাখ রচনা
5. রবীন্দ্র জন্মোৎসব রচনা