সারদামণি বা সারদা দেবী রচনা
মাতা সারদামণি রচনা
ভূমিকা
“যদি, শান্তি চাও কারও দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপনার করে নিতে শেখো। কেউ পর নয়, জগৎ তোমার।”
ভারতের শাশ্বত আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে আধুনিক যুগকে সমন্বিত করে পরিপূর্ণ সত্যকার মাতৃমূর্তিতে, পাতানো মা নয়, পুণ্যবানের মা নয়, হিন্দু উচ্চকোটির মা নয়, ডাকাত আমজাদের মা হয়ে যিনি বিশ্বমায়ের শান্তির ছায়া দান করেছিলেন, ব্রজসুন্দরের কাছে যিনি কারও দোষ না দেখতে পাওয়ার প্রার্থনা জানিয়েছিলেন তিনি সবার মা সারদা! প্রকৃত সুখের সন্ধান, শান্তির সন্ধান, সংসারকে স্বর্গময় করার যে সহিষ্ণুতা, ধৈর্য, উদারতা, মানবতা, স্নেহ, সেবার তপোভূমি করার পথ দেখিয়েছিলেন নারীত্বের আদর্শ সারদামণি ।
পরিচয় ও বাল্যজীবন
১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটি গ্রামে সারদা জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় আর মায়ের নাম শ্যামাসুন্দরী দেবী। বাড়ির কাজে, গৃহস্থালির কাজে অত্যন্ত ছেলেবেলা থেকেই সহায়তা করতেন। দুর্ভিক্ষের সময় তাঁর পিতা অন্নদানব্রতে একান্ত বালিকা সারদা ধান শুকানো, চাল করায় এবং গরম খিচুড়ি পাখার বাতাস দিয়ে ক্ষুধার্তকে সেবার সুবিধা করে দেওয়ার পরম সেবাব্রতে জননী সারদাকে দেখা যায়।
ভাইদের বই নিয়ে নাড়াচাড়া করলেও পড়াশোনা ঠিক হয়ে ওঠেনি সারদামণির। বড়ো হয়ে নিজের চেষ্টায় পড়তে শিখেছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের সাহচর্য
মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই গদাধরের সঙ্গে বিয়ে হয় ‘কুটোবাঁধা’ সারদামণির সঙ্গে। বিয়ে উপলক্ষে কয়েকদিন কাটিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ আবার দক্ষিণেশ্বরে ফিরে গেলেন, সাধনভজন ও সিদ্ধিতে মগ্ন হয়ে গেলেন। সারদা ফিরে এলেন তাঁর মা-বাবার কাছে। সারদামণির যখন বয়স চোদ্দ, শ্রীরামকৃষ্ণ কিছুদিনের জন্য কামারপুকুর এলেন। সারদামণিও এলেন। স্বামী রামকৃষ্মের সদানন্দ মূর্তি, ভগবৎ সাধনাসম্বন্ধে অমৃতময় কথা শুনে সারদার মন ভরে গেল। লোকের দেওয়া অপবাদ—তার স্বামী পাগল হয়ে গেছে,—একটা পাথরের বোঝা ছিল সারদার বুকে। তা পায়াণভার নেমে গেল। ঈশ্বরপ্রাণ মানুষকে বিষয়প্রাণ গৃহস্থরা তো পাগলই বলবে।
দক্ষিণেশ্বরে সারদামণি
স্বামীর সম্বন্ধে গুজবের তো অন্ত নেই, তার ওপর সেই সর্বত্যাগী, সর্বশুদ্ধ, ঈশ্বরগতপ্রাণ স্বামীটিকে দেখার প্রবল ইচ্ছায় বাবার সঙ্গে রওনা দিলেন দক্ষিণেশ্বরে। দক্ষিণেশ্বরের নহবতখানার একতলায় জগদীশ্বরীর ঠাই হল। ওইটুকু ঘরকে সাজিয়েগুজিয়ে শুরু হল স্বামীসেবা, সেবাব্রত আর সাধনভজন। নিস্তব্ধ রাত্রিতে জ্যোৎস্নালোকিত গঙ্গাবক্ষের দিকে অপলক নয়নে চেয়ে চেয়ে বলতেন, 'জ্যোৎস্নার মতো নির্মল হোক আমার জীবন। এখানেই ভাবসমাধি হত তাঁর।
ষোড়শীরূপে আরাধিতা সারদা মা
শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সাধনসঙ্গিনী সারদাকে ষোড়শীদেবীরূপে পূজা করলেন। সারদা মাতৃভাবে অধিষ্ঠিতা হলেন। দাম্পত্য সম্পর্ক এক দিব্যমহিমায় হল উন্নীত। জগতে নারী পূজিতা হলেন। দেবীরূপে “যত্র নার্যস্তু পূজ্যতে রমন্তে তন্ত্র দেবতা”—নারী যেখানে পূজিতা, সেখানে দেবতাদের অধিষ্ঠান ঘটে।জয়রামবাটির সারদা হলেন বিশ্বজননী জগন্মাতৃকার প্রতিনিধি।
নিখিল জননী ও সঙ্ঘজননীরূপে আবির্ভাব
১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট ঠাকুর অমরধামে প্রয়াণ করলেন। সারদামণি হলেন সঙ্ঘজননী। তিনি নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন, “আমি সত্যিকারের মা, গুরুপত্নী নয়, পাতানো মা নয়, কথার কথা মা নয়—সত্য জননী।” (শ্রীমা সারদা দেবী, পৃঃ ২৩৬)। শ্রীরামকৃষ্ণের অবর্তমানে তিলে তিলে ধীরে ধীরে গড়ে উঠল এক বিরাট সঙ্ঘ, মানবসেবা, আধ্যাত্মিক চর্চার এক বিশাল কর্মযজ্ঞ, ধ্যানযজ্ঞ। যাঁকে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, ‘ছাইমাখা বেরাল’—অর্থাৎ দেখে বোঝার উপায় নেই, কিন্তু আসলে বিশ্বমাতৃকা, স্বামী বিবেকানন্দ যাঁকে বলেছেন, ‘জ্যান্ত দুর্গা’ অর্থাৎ সাধারণ মানবী নন, দুর্গাস্বরূপিনী তিনি সহস্র সহস্র মনে জ্ঞান, প্রেম, ভক্তি সঞ্চারিত করেছেন সেবা, দীক্ষায়, জপে, স্নেহে। “দয়াময়, তাদের পরকাল দেখিও।”
তিরোধান
নিবেদিতা বলেছেন, “ভারতীয় নারীকুলের আদর্শ সম্বন্ধে শেষ কথা তিনিই।” তিনি বলেছেন, “মা বলে এলে আমি যে থাকতে পারি নে।” “আমরা তো ওই জন্যই এসেছি। আমরা যদি পাপতাপ না নেব, ভজন না করব, তবে কে করবে ?” (তাদেব, পৃঃ ৩৩৭)। সন্তান ও ভক্তদের স্নেহডোর ছিন্ন করে মাতৃরূপা সারদামণি ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ২১ জুলাই (বাং ১৩২৭ সনের ৪ শ্রাবণ) দিব্যধামে গমন করলেন।