বাংলার গ্রাম রচনা
বাংলার গ্রাম- একাল ও সেকাল রচনা
বাংলার এত অপরূপ সুন্দর দৃশ্য দেখে কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলার প্রতি মুগ্ধ হয়ে তাইতো বলেছেন-
“বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর"
গ্রাম বাংলার সুনিবিড় ছায়াঘন রূপ, সুজলাসুফলা শস্যশ্যামলা নিভৃত পল্লির এক স্নিগ্ধ ছবি যেন সব পাওয়ার সৌন্দর্যডালি এখানে মেলে ধরেছে।
প্রকৃতির অকৃপণ দান, মন-ভোলানো প্রাণ ভরানো সৌন্দর্য, হাটেমাঠে বাটে সবুজের সমারোহ, শান্ত পল্লির পাশ দিয়ে বয়ে চলা স্বচ্ছসলিলা তরঙ্গিনী,—মাঝিমাল্লার ভাটিয়ালি গান—এই উদাস, উদার, উন্মনা পল্লিপ্রকৃতির রূপ।
বিভিন্ন ঋতুতে গ্রাম-প্রকৃতি
গ্রাম-প্রকৃতি নানা ঋতুতে নানা রূপের মাধুর্যে সুন্দর। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠে সূর্যের খরদীপ্তিতে তপস্বীর মূর্তি, বর্ষায় মেঘমেদুর প্রকৃতিলোকে সুখীর মনে কী এক না পাওয়ার বেদনা, শরতের শ্যামায়মান শস্যক্ষেত্রের উপর নির্মেঘ নীলিমার প্রসন্ন দৃষ্টি, ডালাভরা ফসলের ডালি নিয়ে পৌষের ডাক, শীতের জড়তার অন্তরালে উষ্মতার আকাঙ্ক্ষা আর বসন্তের মাতাল বাতাসে টলেপড়া মত্তচপল আনন্দ-গ্রামবাংলাকে নানা বৈচিত্র্য ভরিয়ে দেয়।
গ্রাম বাংলার মানুষ
গ্রামের মানুষ সহজ, সরল—আবাদ করে বিবাদ করে আবার কী এক অচ্ছেদ্য নিবিড় বন্ধনে যেন বাঁধা। জীবনযাত্রা সহজ, অভাব অনটন আছে, কিন্তু অভাববোধ তীব্র নয়। অভাবের মধ্যে তৃপ্তির স্বাদ। হাড়ি, মুচি, ডোম, আদিবাসী, কায়স্থ, বৈদ্য, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, তাঁতি, তাম্বুলি, কুমোর প্রভৃতি নানা জাতির নানা ঐশ্বর্যে, শিক্ষার, রুচির জীবনযাত্রা, বৃত্তির আশ্চর্য সহাবস্থান। অনেকটা নিস্তরঙ্গ, শান্ত, গতানুগতিক জীবনধারা। ভালো শিক্ষার ব্যবস্থা নেই, চিকিৎসার প্রায় কোনো ব্যবস্থাই নেই।জড়িবুটি, তাবিজ, মাদুলি, জলপোড়া, ওঝা, গুনিন, ভুঁইপুর ওস্তাদের শেষরাতে যার আর বামুনদের পাঁজিপুঁথির বিধান মেনেই ঝড়ে, বৃষ্টিতে, ঠান্ডায়, বানে বন্যায় আর উৎসবে দিনগুলো কাটায়। প্রায় নিস্তরঙ্গ জীবনযাত্রার কোনো ঘটনার আকস্মিকতা তরঙ্গ তোলে আবার থেকে যায় লোকের মুখে মুখে পল্লবিত হয়ে বেঁচে থাকে, পুরাণ কথা হয়ে। শহর-জীবন বিস্ময় সৃষ্টি করে, কিন্তু তার সঙ্গে যোগাযোগ খুব নিবিড় নয়—এই ছিল গ্রামবাংলার পুরোনো দিনের চিত্র।
আজকের গ্রাম
কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন-
“এখানে নবান্নের ঘ্রাণ ওরা সেদিনও পেয়েছে—কিন্তু বাংলার লক্ষ গ্রাম নিরাশায় আলোহীনতায় ডুবে নিস্তব্ধ নিস্তেল।”
রবীন্দ্রনাথও বলেছিলেন, - “গ্রামের চাষিরা ভদ্রলোকদের বিশ্বাস করে না। তারা তাদের আবির্ভাবকে উৎপাত এবং তাদের মতলবকে মন্দবলে গোড়াতেই ধরে নেয়।”
আজ কিন্তু গ্রামবাংলা তার অপমানের ধুলি শয্যা ছেড়ে আবার নবতর গঠনের পথে এগিয়ে চলেছে। গ্রামের দরিদ্রের পর্ণকুটিরের জায়গায় পাকা কোঠা বাড়ি, অঙ্গনে বাঁধা ধানের মরাই, অন্দরে বাজে বেতার কিংবা দূরভাষণের সংগীত মূর্ছনা, নয়তো বেদম নাচের প্রায় নগ্ন কসরৎ। গ্রামে গ্রামে পঞ্চায়েত, রাজনৈতিক দলের মদতে মজুরি বৃদ্ধি, পুরাতন কৌলিন্যকে ভেঙে দুমড়ে দেওয়া, শিক্ষার জন্য শিক্ষাসূত্রের সঙ্গে মধ্যাহ্নিক অন্নসত্র, বিদ্যুতের আলো, পীচঢালা বা মোরাম দেওয়া রাস্তা, নিত্য দিনের সংবাদপত্র, ক্রিকেট খেলা, বিন লাদেন নিয়ে সোচ্চার আলোচনা, দাতব্য চিকিৎসালয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা। তবু যেন কোথায় একটি ফাঁক পড়ছে। দারিদ্র্য যেন গোপন রোগের মতো কুরে কুরে খাচ্ছে। পড়ুয়াদের পড়া ছেড়ে দেওয়া, চিকিৎসালয়ে ডাক্তার, ওষুধ, পরিষেবার অভাব, বিদ্যুতের লোডশেডিং, রাত্রির অন্ধকারে ডাকাতির বিভীষিকা, দলে দলে বোমাবাজি, অবিশ্বাসের বিষাক্ত ক্ষত যেন গ্রামবাংলাকে পীড়িত, মুমূর্ষু করে তুলেছে। এই উন্মত্ত উদ্ভ্রান্ত জাগরণের মুহূর্তে ভালোমন্দকে চেনা যাচ্ছে না, ন্যায় অন্যায়কে বিচার করা যাচ্ছে না, সুস্থ ও অসুস্থকে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে, শুভঙ্কর শক্তিকে অশুভ-অসুর পরাস্ত করছে। তবু গ্রামবাংলা জাগছে, সৃষ্টির নতুন সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে।
উপসংহার
আজ বাংলায় সাময়িক পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে অনেক বিত্তবান গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যাচ্ছেন। সুযোগে অনেক প্রতিভা দেশের নানা স্থানে পাড়ি দিচ্ছে, বিদেশেও যাচ্ছে। ফলে নানা জাতের সমন্বয় ঘটছে। যাই ঘটুক ঝড় থেমে গেলে, বন্যার অবসান হলে কিংবা তাদের ধ্বংসের সময়কালে বা পূর্বেই একটি সুরাহার পথ, প্রতিকারের পথ বুদ্ধিমান মানুষকে ভাবতেই হয়। গ্রামকে ছেড়ে দিলে চলবে না, শুধু ভাঙলেই চলবে না, গ্রামকে বরণ করে নিতে হবে, গড়নটা তার বজায় থাকা চাই—তাকে সর্বদিক দিয়ে উন্নত করতে হবে এবং সর্বোপরি কল্যাণমুখীও করে তুলতে হবে। গ্রামবাংলা যেন “ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়” হয়েই যে বাংলার, ঐশ্বর্য ও ঐতিহ্য নিয়ে নবরূপে আবির্ভূত হয়।