স্বদেশি আন্দোলনের বিভিন্ন ধারা আলোচনা করো।
স্বদেশী আন্দোলনের বিভিন্ন ধারা
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত হয় তা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন বা স্বদেশী আন্দোলন নামে খ্যাত। এই আন্দোলনের দুই চরিত্রের একটি স্বদেশ ও অন্যটি বয়কট। স্বদেশ-বয়কটের পরিপূরক হিসেবে স্বদেশী চিন্তাধারার বিকাশ ঘটে। স্বদেশী ও বয়কট এই দুই কর্মপন্থা অবলম্বন করে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তা সার্বিকভাবে স্বদেশী আন্দোলন নামে পরিচিত।
স্বদেশি আন্দোলনের প্রসার
স্বদেশী আন্দোলন বাংলাদেশে প্লাবনের মতো প্রসার লাভ করে। গ্রামে গঞ্জে সভা-সমিতি ও বক্তৃতার মাধ্যমে বিলাতি দ্রব্য বর্জন ও স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা প্রচার করা হয়। ক্রমশ রাজনীতির সীমাবদ্ধ গন্ডি ছাড়িয়ে শিক্ষা, সাহিত্য সংস্কৃতি তথা শিল্পের জগতেও স্বদেশি আন্দোলন সম্প্রসারিত হয়।
স্বদেশি শিল্পের বিস্তার
স্বদেশি আন্দোলনের ফলস্বরূপ দেশের বিভিন্ন স্থানে কুটির শিল্প এবং দেশীয় পরিচালনায় বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। বাংলায় ড. প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানা স্থাপন করেন। ডাঃ নীলরতন সরকার জাতীয় সাবান কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। মাদ্রাজে চিদাম্বরম পিল্লাই স্বদেশি জাহাজ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে বিদেশি যুগে ভারতে শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ইতিহাস উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হল স্যার জামসেদজী টাটা কতৃক প্রতিষ্ঠিত জামসেদপুরের লৌহ ও ইস্পাত কারখানা।
ছাত্রসমাজের ভূমিকা
স্বদেশি আন্দোলনে ছাত্রসমাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা বিদেশি কাগজ, কলম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বর্জন করে। এমনকি তারা বিদেশি কাপড়, লবণ, চিনি, মদ প্রভৃতি দোকানের সামনে পিকেটিং করে। ছাত্রদের দমন করার জন্য সরকার কার্লাইল সাকুলার জারি করেন। বহিষ্কৃত ছাত্রদের শিক্ষালাভের জন্য জাতীয় শিক্ষার কর্মসূচী গ্রহণ করা হয় এবং এই উদ্দেশ্যে ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ' গঠন করা হয় (মার্চ ১৯০৬)।
জাতীয় শিক্ষার বিস্তার
স্বদেশী আন্দোলনের যুগে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের নেতৃত্বে জাতীয় মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সঙ্গে বাংলার বিভিন্ন স্থানে ২৪টি মাধ্যমিক ও ৩০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এমনকি জাতীয় শিক্ষার আদর্শ বাংলার বাইরেও জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
সাহিত্য সংস্কৃতি
স্বদেশি আন্দোলনের যুগে শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য, সংগীত ও নাটক রচনার মধ্য দিয়ে জাতীয় আন্দোলনের আদর্শ প্রচারিত হয়। এদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন ও রজনীকান্তের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। স্বদেশি শিল্পকর্মে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নন্দলাল বসু অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন।
সংবাদপত্রের ভূমিকা
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন প্রচারে এবং স্বদেশি আন্দোলনের যুগে সংবাদপত্রের ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই ক্ষেত্রে কৃষ্ণকুমার মিত্র সম্পাদিত ‘সঞ্জীবনী’ সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বেঙ্গলি’ বিপিন চন্দ্র পাল সম্পাদিত ‘বন্দেমাতরম’ ভূপেন্দ্রনাত দত্ত সম্পাদিত ‘যুগান্তর’ এবং ব্রহ্মবান্ধব সম্পাদিত ‘সন্ধ্যা' পত্রিকার ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয়।
আন্দোলনের অবসান
প্রবল সরকারি দমন নীতির চাপে কলকাতায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের তীব্রতা ক্রমশ শিথিল হয়ে আসে। তবে পূর্ব বাংলায় ঢাকা ও বরিশালে স্বদেশি আন্দোলন ক্রমশ গণমুখী ও গতিশীল হয়ে ওঠে। অশ্বিনী কুমার দত্ত তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্বদেশ বান্ধব সমিতির ১৫৯টি শাখার মাধ্যমে বরিশালকে আন্দোলনের দুর্জয় ঘাঁটিতে পরিণত করেন।
মূল্যায়ন
আপাতদৃষ্টিতে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলন ব্যর্থ মনে হলেও তা প্রকৃত অর্থে ব্যর্থ হয়নি, কারণ, এই আন্দোলন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ঐক্য ও সংহতি স্থাপন করতে সাহায্য করে।