শিশু শ্রমিক রচনা
শিশু শ্রমিক রচনা
প্রকৃতির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে সদা হাস্যময় শিশুর সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। ধনী পরিবারের প্রাণচঞ্চল শিশুরা আকাশচুম্বী ভাবনার জগতে মত্ত, অপরদিকে দীন-দরিদ্র পরিবারের অভুক্ত বা অর্ধভুক্ত শিশুরা কলকারখানা, চায়ের দোকানে বা অপরের বাড়িতে উদয়াস্ত পরিশ্রমে রত। মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুরা কিছুটা পড়াশুনা, বাকি সময় বাড়ির কাজে সাহায্য করাই তাদের মূল মন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবেই শিশু শ্রমিকের সংখ্যা দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই ভারতবর্ষে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় দশ কোটি।
উদ্ভবের কারণ
দরিদ্র পরিবারে একক পরিশ্রমলব্ধ আয়ে বহু সন্তানবিশিষ্ট পরিবারের ব্যয়ভার বহন করতে না পেরে পুত্র-কন্যাদের শৈশবে কাজে নিযুক্ত করা হচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ না করেই তারা আহার অন্বেষণে অল্প মজুরির বিনিময়ে কঠোর শ্রমের কাজে লাগতে বাধ্য হয়। শিশু শ্রমিকদের কোনো ইউনিয়ন বা সংগঠন নেই বলেই তারা পূর্ণ বয়স্ক শ্রমিকের সমান কাজ করলেও সেই হারে মজুরি পায় না। কিন্তু বেশি কাজ পাওয়া সম্ভব বলেই মালিক বা বিত্তশালীরা শিশুদেরই বেশি পছন্দ করেন। সংগত কারণেই শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আইনগত দিক
ভারতবর্ষে শিশু শ্রমিক নিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ আইন অনুসারে ১৪ বছর পর্যন্ত বালক বালিকাদের শিশু শ্রমিকের পর্যায়ে ফেলা হয়েছে। যে হিসাবে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা, সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রায় চার কোটি চুয়াল্লিশ লক্ষ। তার মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ শিশু কাজ করে নানা কলকারখানায় এবং বাকি ৩০ শতাংশ বিভিন্ন দোকানে কাজ করে এবং অবশিষ্ট অংশ স্বয়ং উদ্যোগে অন্ন সংস্থানের প্রাণান্তকর সংগ্রামে নিযুক্ত। আইনে বলা আছে, ১৪ বছরের নীচে শিশুদের কলকারখানায় নিয়োগ করা যাবে না, নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কোনো আইন বা শর্ত লঙ্ঘন করলেও শিশু শ্রমিকদের কোনো গুরুতর শাস্তি দেওয়া চলবে না। কিন্তু সবই খাতা কলমে।
বিভিন্ন অঞ্চলে শিশু শ্রমিকের ধরন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ভারতে শিশু শ্রমিকদের যে ধরনের অস্থাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে হয় তা স্বাস্থ্য ও মনের পক্ষে ক্ষতিকর। আতসবাজী, বে-আইনী বোমা ইত্যাদি বিপজ্জনক দ্রব্য তৈরির ক্ষেত্রেও অপরিণত শিশু শ্রমিকদের নিয়োগ করার ফলে অনেক সময় শিশু শ্রমিকদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে। শিবকাশীর দেশলাই বা আতসবাজী কারখানায় কাজ করে প্রায় তিন বছর থেকে পনেরো বছরের শিশু। উত্তর প্রদেশের ফিরোজাবাদে কাচ বা পুঁতি কারখানায় কাজ করে প্রায় অর্ধলক্ষ শ্রমিক। বিভিন্ন অঞ্চলের তাঁত শিল্পে শিশু শ্রমিক কাজ করে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত। পশ্চিমবঙ্গে বিড়ি শিল্পে, চাষ-আবাদে এবং রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে হিসাবে কাজ করে অসংখ্য শিশু শ্রমিক খাদ্যের বিনিময়ে। কিন্তু তাদের খাদ্যের জোগান শিশুর পুষ্টির তুলনায় হাস্যকরভাবে অপ্রতুল।
প্রতিকার
শিশু শ্রমিক সমস্যাটি পুরোপুরি রদ করা সম্ভব হবে না। বস্তুত সরকারের সক্রিয় উদ্যোগে শিশু শ্রমিকের পুনর্বাসন বা উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা না করে এই আইন বলবৎ করা হঠকারিতা হবে। কারণ শিশু শ্রমিক সমস্যা শুধুমাত্র ভারতবর্ষের নয়, এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। তাছাড়া শিশু শ্রমিক নিয়োগকে রদ করার মতো সুদৃঢ় আইন নেই। শ্রমিকরাই তার প্রতিপক্ষ প্রবল বাধা। স্বাধীনতার এত বছর পরেও সরকার শিশু শ্রমিকের সার্বিক বন্ধন মোচনে অক্ষম। 'ন্যাশানাল অর্থরিটি অব চাইল্ড লেবার' এর কাজ শুরু হয়েছে
১৯৯৪ সালের ২ অক্টোবর মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিনে। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য শিশুদের লেখাপড়া শেখানো এবং পেশাগত শিক্ষা দেওয়া। এদের আয়ের উপর নিজ নিজ পরিবারের নির্ভরতা। সেদিকেও সরকার লক্ষ দেবেন।
উপসংহার
ভারতের মতো দরিদ্র ও বিশাল দেশে শিশুদের জন্য কল্যাণকর প্রকল্প অবশ্য প্রয়োজন হলেও রূপায়ণ করা কঠিন। সেই সঙ্গে পূর্ব বাংলা থেকে আগত উদ্বাস্তুদের সমস্যাও একটা বিশাল সমস্যা। শিশুদের বাসযোগ্য’ করা সম্ভবপর হচ্ছে না। বর্তমান প্রশাসন শিশু শ্রমিক নিরোধ আইনটির কথা মনে রেখে শ্রমজীবী শিশুদের পারিপার্শ্বিক অবস্থার উন্নতির দিকে অধিকতর আগ্রহী হয়েছেন। আশা করা যায়, একবিংশ শতকের নবোদিত সূর্যালোকে কোনো মুক্ত প্রাণ জ্যোতি বিচ্ছুরিত হবে।
ভালো