তোমার প্রিয় বিজ্ঞানী রচনা (মেঘনাদ সাহা)
তোমার প্রিয় বিজ্ঞানী রচনা (মেঘনাদ সাহা)
‘বিশ্ববিজ্ঞানে এক নতুনের হাওয়া,বাঙালি-বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা।'
ভূমিকা: দৈন্যপীড়িত এক পরিবারে জন্ম নিয়ে যিনি বিশ্ববিজ্ঞানের মহাকাশে মন্ত্রধ্বনিতে বিশ্ববাসীকে সচকিত করেছেন—তিনিই বাঙালি বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। বিশ্ববিজ্ঞান পরিমণ্ডলের তিনি ছিলেন এক অগ্রণী সদস্য। একবিংশ শতাব্দীতেও তাঁর ত্যাগ, আদর্শ ও বিজ্ঞান চিন্তা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। বলা বাহুল্য, তিনি বাঙালির গর্ব, বাঙালির অহংকার।
মেঘনাদের শৈশব ও প্রতিভার বিকাশ:
বিজ্ঞান-তপস্বী মেঘনাদ সাহা অবিভক্ত বাংলার ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ই অক্টোবর এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। দারিদ্র্যের মধ্যেই মেঘনাদ লালিতপালিত হন। তাঁর মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিকে কোনো অভাব অনটন গ্রাস করতে পারেনি। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম স্থান লাভ করে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তৎকালীন শিক্ষাতীর্থ প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অঙ্কশাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ফলিত গণিত শাস্ত্রে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান। শিক্ষা ও সাধনায় এই মহাবিজ্ঞানী ছিলেন সরস্বতীর সাক্ষাৎ বরপুত্র।
গবেষণা : সাধনা ও সিদ্ধিঃ
‘বাংলার বাঘ’ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ছত্রছায়ায় এম. এস-সি. পাস করার পরই মেঘনাদ সাহা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। তাঁর সুপ্ত বাসনার একটা কোরক সেদিন সবে প্রস্ফুটিত হল। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে গবেষণা করে ডক্টরেট ডিগ্রি এবং পরের বছরই কৃতি গবেষক হিসেবে তিনি ‘প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ’ বৃত্তিপ্রাপ্ত হন। বঙ্গজননীর সুসন্তান অবশেষে উচ্চতর গবেষণার জন্য বিদেশে গমন করেন এবং একে একে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ করে বিশ্ববিজ্ঞান চিন্তার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেন। বাঙালির গর্ব মেঘনাদ সাহা বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, গ্রোটিয়ান, প্ল্যাঙ্ক প্রমুখ মহান ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে আসেন এবং তাঁর জীবিতকালেই বিশ্বের বারো জন বিজ্ঞানীর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী রূপে স্বীকৃতি পান।
আবিষ্কার ও স্বীকৃতিঃ
ডঃ সাহার অবিস্মরণীয় কীর্তি হল, জ্যোতিপদার্থ বিজ্ঞান। বর্তমানে 'নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’ নামে পরিচিত এই বিশ্ব-বিজ্ঞান ক্ষেত্রে যে বিষয়কে কেন্দ্র করে বিজ্ঞানী সাহার খ্যাতি জগৎজোড়া, সেগুলো হল,—তাপগতিতত্ত্ব, পরমাণু বিজ্ঞান, বর্ণালী বিজ্ঞান প্রভৃতি। বর্তমান শতাব্দীর বিজ্ঞানাকাশে ‘তাপীয় আয়নন তত্ত্ব’ মেঘনাদ সাহার অভিনব সংযোজন। পারমাণবিক গবেষণার ক্ষেত্রে মেঘনাদ সাহা প্রতিষ্ঠিত ‘সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’ কেন্দ্রটি সমস্ত বিশ্বে বিশিষ্ট মর্যাদালাভে সক্ষম হয়েছে।
মানবকল্যাণঃ
আণবিক শক্তিকে দুটো বিশ্বযুদ্ধ যখন ধ্বংসের কাজে ব্যবহার করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যায় কলঙ্ক লেপন করেছিল, ঠিক সেই সময় ডঃ সাহা আণবিক শক্তিকে মানব কল্যাণে নিয়োজিত করেন। তাঁর সাধনায় পরবর্তীকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সাইক্লোট্রোন যন্ত্র’ গবেষণার নতুন যুগের সূত্রপাত ঘটায়। ইউরোপ-আমেরিকার জড়বিজ্ঞান সাধনা যে উন্মত্ততা প্রদর্শন করেছে, ডঃ মেঘনাদ সাহা তার অসারতা প্রমাণ করেছেন নিজ ধী-শক্তি ও পাণ্ডিত্যের মাধ্যমে।
ভারতীয়তাবোধঃ
মেঘনাদ সাহা হলেন বিশ্ববিজ্ঞান সাধনার এক অনন্য প্রতিভাধর সাধক। তিনি তাঁর প্রতিভার দ্বারা প্রচুর অর্থবিত্ত সঞ্চয় করতে পারতেন। বিজ্ঞান ভাবনাকে তিনি ব্যবসার সামগ্রী করতে চাননি বলে, আজ সকল শ্রেণির মানুষের কাছে তিনি শ্রদ্ধার্হ। তিনি সর্বজনের নমস্য। মানব কল্যাণের
জন্য তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন সম্পূর্ণরূপে। ভারতবর্ষের সীমাহীন দারিদ্র্য তাঁর গবেষণায় বিঘ্ন ঘটিয়েছে সন্দেহ নেই, তবুও তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি, হতাশ হননি। বরং ভারতের লুপ্ত ও মৃত বিজ্ঞান সাধনায় নতুন প্রাণ সঞ্চার করে বিশেষ গতিপ্রবাহ দান করেন।
মহাজীবনের পরিসমাপ্তিঃ
ভারতবর্ষে বৈদিক যুগ থেকে যে বিজ্ঞান সাধনা চলে আসছে, সেই ধারাকে অক্ষুণ্ন রাখতে যাঁদের অবদান অপরিসীম, তাঁদের মধ্যে ডঃ মেঘনাদ সাহা হলেন অন্যতম। ভারতীয় বিজ্ঞান-মঞ্চের তিনি ভগীরথতুল্য ব্যক্তিত্ব। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে এই মনীষীর আকস্মিক জীবনাবসান ঘটে। দীর্ঘদিনের মন্ত্রসাধনায় তিনি যেমন সিদ্ধিলাভ করে সিদ্ধপুরুষ হয়েছিলেন, তেমনি তাঁর দেহাবসানে বিজ্ঞান গবেষণায় নেমে আসে নিদারুণ শূন্যতা ও শোকের ছায়া। কিন্তু, ‘কীৰ্ত্যিযস্য সঃ জীবতি’। সুতরাং কীর্তি ও সর্বজনের শ্রদ্ধার স্বীকৃতির মাধ্যমেই তিনি অমরত্বের আসনে চিরপ্রতিষ্ঠিত এবং ওই যারা দিনরাত্রি আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’—বিশ্ববিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা হলেন তাঁদের পথপ্রদর্শক।
এই রচনার তথ্য থেকে আরও যে যে প্রবন্ধ লেখা যায়, সেগুলি হল :
1. তোমার প্রিয় এক বিজ্ঞানী রচনা
2. আধুনিক কালের এক শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী রচনা
3. একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি বিজ্ঞানী প্রবন্ধ রচনা
4. একজন বাঙালি বিজ্ঞানী রচনা
আরো পড়ুন-