বিজ্ঞান ও কুসংস্কার রচনা

বিজ্ঞান ও কুসংস্কার রচনা

যখনই বিজ্ঞান, লইয়া প্রমাণ তর্জনী তুলিয়া দাঁড়ায়।
তখনই কুসংস্কার ছাড়িয়া হুংকার, রাজ্য ছাড়িয়া পালায়।
অবৈজ্ঞানিক মন
একবিংশ শতব্দীতে পা দিয়েও—আমাদের মন থেকে কুসংস্কারের ভূত যায় নি। আজও সে আমাদেরকে ভয় দেখায়। কারণ, টিকটিকি ডাকলে অশুভ জ্ঞান করি, হাঁচি পড়লে আমরা থেমে যাই, পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে দইয়ের ফোঁটা পরে যাই। এ সব বিশ্বাস কি আমাদের সংস্কার ? না কুসংস্কার ?
কুসংস্কার কী?
কুসংস্কার হল মানুষের অন্ধ বিশ্বাস, মিথ্যা ধারণা। ইংরেজিতে একে বলে 'Superstition' যা বহুদিন ধরে চলে আসছে—এমন অন্ধ বিশ্বাস মানুষের অজ্ঞতার কারণে কুসংস্কারে পরিণত হয়েছে। বিজ্ঞানের যুগেও মানুষ তন্ত্রমন্ত্র ঝাঁড়ফুক করে ভূত প্রেত, ডাইনি, জিন ইত্যাদি তাড়ায়।
আধুনিকতা ও বিজ্ঞান চেতনাঃ
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই মানুষ প্রকৃতির রহস্য ভেদ করার এবং অবাধ্য প্রকৃতিকে নিজের আয়ত্তে আনার চেষ্টা করছে। তাই প্রাচীন গ্রন্থগুলির মধ্যে আমরা পাই বিজ্ঞান চর্চার কিছু কিছু আভাস। কখনও জ্যোতির্বিজ্ঞানের আভাস, কখনও বা পদার্থবিদ্যার তত্ত্ব আমরা দেখতে পাই। ঋকবেদের সূক্তে বা বাইবেলের কবিতায়। আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরােপে রেনেশাঁসের পরে বিজ্ঞানচর্চার সূচনা দেখা দেয়। মানুষের বস্তু জগতে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য এবং আরাম বহন করে আনল বিজ্ঞানের নানা
আবিষ্কার। এরই প্রবাহ বেয়ে আমরা পেলাম দ্রুতগামী যন্ত্রচালিত যান, বৈদ্যুতিক আলাে, উন্নত সংযােগ ব্যবস্থা, জীবনদায়ী ওষুধ।
অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্তি পেতে হলেঃ
বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান প্রসার মানুষের অন্ধবিশ্বাস, অসহায় ধর্ম-আনুগত্যের অচলায়তনে আঘাত হানল। সেই প্রথম মানুষ সন্দেহ প্রকাশ করল ধর্মীয় ব্যাখ্যায়। এই সন্দেহবাদ মানুষকে এগিয়ে দিল যুক্তিতর্কের দিকে। গড়ে উঠল নতুন এক মূল্যবােধ এবং বিশ্বাস, মানুষ বুঝল, সব প্রাচীন তত্ত্ব, তথ্য এবং মতবাদই চোখবুজে গ্রহণযােগ্য নয়, বিচার ও যুক্তিশীলতার কষ্টিপাথরে যাচাই করে তবেই গ্রহণীয় হবে সবকিছু। এই সন্দেহের মধ্য দিয়ে মানুষের যথার্থ বিজ্ঞান-যুক্তির প্রতি বিশ্বাসই বৃদ্ধি পেল। কবি Tennyson তাই বলেছিলেন, 'There live many faiths in honest doubt'
অন্ধ কুসংস্কার কাকে বলে?
বিজ্ঞানচেতনার মাধ্যমে প্রকৃতির বিপরীতমুখিতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই অবস্থান করছে কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাস। একদিকে যখন চলছে বিজ্ঞানের জয়যাত্রা, অন্যদিকে ইংল্যাণ্ডে তখনও ডাইনি বলে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে অসহায় নারীদের। ভারতে চলছে সতীদাহ-সহমরণ, চলছে হাঁচি-টিকটিকি, মাদুলি-তাবিজ-কবচ। অতি সুসভ্য সমাজে আজও টিকে রয়েছে এমন ধরনের কত অন্ধবিশ্বাস। কালাে বিড়াল সামনে দিয়ে গেলে সুসভ্য ইউরােপের অনেক লোকই আজও গাড়ি থামিয়ে বসে থাকে। আবার ইংল্যান্ডের নাবিকেরা সমুদ্র যাত্রার সময় সঙ্গে করে নিয়ে যায় কালাে বিড়াল, কারণ তারা বিশ্বাস করে এই বিড়ালই তাদের জাহাজডুবি থেকে রক্ষা করবে। আজও অনেক সুশিক্ষিত মানুষ খাওয়ার টেবিলে তেরাে জনে খেতে বসেন না। কিন্তু কেন এই মানসিকতা? কী এর উৎস? এর কারণ মানুষের কুসংস্কার, যা কিছুতেই যেতে চায় না। এমন কিছু ক্ষেত্র আছে যেখানে বিজ্ঞান এখনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। এ শতকের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন কুসংস্কারের উৎস হল— “It is this undefined source of fear and hope which is the genesis of irrational superstition" ভয় এবং আশার এই অব্যাখ্যাত উৎস থেকেই অযৌক্তিক কুসংস্কারের সৃষ্টি।
সামাজিক কুসংস্কার যা এখনো প্রবলঃ
আধুনিক ভারত যদিও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির পথে এগিয়ে চলেছে, তবু আমাদের দেশ আজও কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ। আজও ডাইনি হত্যা, শিশু বলির মতাে ঘটনা ভারতের বুকে প্রায়শই ঘটে চলেছে। তবু সবচেয়ে বিস্ময়কর এবং লজ্জাজনক বােধহয় ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের ২১শে সেপ্টেম্বরের ঘটনা। গণেশ মূর্তির দুধপান। পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় যা পৃষ্ঠ টান। বর্তমানে সমুদ্রের জল সুপেয় হওয়ার ঘটনাও কুসংস্কারের পর্যায়ে পড়ে।
শিক্ষিত মানুষের কুসংস্কারঃ
সঠিক অর্থে কুসংস্কার মানে সেইসব আচরণ যা ব্যক্তি ও মানুষের মনে জাগিয়ে তােলে অহিতকর মানসিক অন্ধত্ব! আমাদের দুঃখ এই যে, আমাদের দেশে বিজ্ঞান জেনেও বহু মানুষ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। বৈজ্ঞানিকদের হাতে তাবিজ-কবচ প্রায়ই দেখা যায়। ডাক্তারেরা নির্ভর করেন জ্যোতিষীর ওপরে। জ্যোতিষীর নির্দেশে বহু শিক্ষিত লোকে হাতে গ্রহরত্ন ধারণ করে চলেছেন। এঁরা জলপড়া খান চোখ বুজে। গুরু চরণামৃত ভক্তির সঙ্গে পান করেন। এইসব কাজের সময় তারা বিজ্ঞানকে দূরে সরিয়ে রাখেন।
পথের দিশাঃ
বিজ্ঞান ও কুসংস্কার দুই-ই মানব মনের ফসল। প্রকৃত যুক্তিবাদী মানুষকে তার সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে খুঁজে নিতে হবে সঠিক এবং মঙ্গলকর পথটি। তবেই পৃথিবী এবং মানবজাতির আলােকময় যাত্রাপথ হবে সুনিশ্চিত। দূরীভূত হবে কুসংস্কার। নতুবা দুইই চলবে পাশাপাশি।

উপরের এ রচনা থেকে আরও যেসব প্রবন্ধ লেখা যেতে পারে-
1. কুসংস্কার থেকে মুক্তি হতে হলে
2. বিজ্ঞানের আলো বনাম কুসংস্কারের অন্ধকার
3. আধুনিক জীবনে বিজ্ঞান বনাম কুসংস্কার

আরো প্রবন্ধ রচনা -
1. বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ
3. জনসাধারণের মধ্যে বিজ্ঞান চেতনার প্রসার
4. পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার
5. গাছ আমাদের বন্ধু
7. বাংলার উৎসব
8. একটি গ্রামের আত্মকথা
9. একটি শহরের আত্মকথা
10. একটি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url